সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় তেরো

তিনি তার ভুলগুলো থেকে শিখেছিলেন

তিনি তার ভুলগুলো থেকে শিখেছিলেন

১, ২. (ক) যোনা নিজের এবং জাহাজের যাত্রীদের ওপর কোন বিপদ নিয়ে এসেছিলেন? (খ) কীভাবে যোনার ঘটনা আমাদের সাহায্য করতে পারে?

যোনা সেই ভয়ংকর শব্দটা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এই শব্দটা জাহাজের মাস্তুলের মধ্যে দিয়ে সজোরে বাতাস প্রবাহিত হওয়ার ভয়ানক শব্দ ছিল না, আবার কাঠের জাহাজের গায়ে বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ার কারণে ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজও নয়। যোনার কাছে এর চেয়েও যেটা আরও বেশি কষ্টকর ছিল তা হল, জাহাজের যাত্রীদের এবং এর চালক ও তার নাবিকদলের চিৎকার, যারা জাহাজটাকে জলের ওপর ভাসিয়ে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। যোনা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেই লোকেরা শুধুমাত্র তার জন্য প্রায় মরতে বসেছে।

কী যোনাকে এইকরম একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে এনে ফেলেছিল? তিনি তার ঈশ্বর যিহোবার অবাধ্য হয়ে এক গুরুতর ভুল করে ফেলেছিলেন। তিনি কী করেছিলেন? যিহোবার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদেরকে অনেক কিছু শেখাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যোনার ঘটনা আমাদেরকে এই বিষয়টা বুঝতে সাহায্য করে যে, এমনকী যাদের অকৃত্রিম বিশ্বাস আছে, তারাও কীভাবে বিপথে যেতে পারে—আর কীভাবে তারা তাদের ভুলগুলোকে সংশোধন করতে পারে।

গালীলের একজন ভাববাদী

৩-৫. (ক) লোকেরা যখন যোনার বিষয়ে চিন্তা করে, তখন প্রায়ই তারা কোন বিষয়টার ওপর মনোযোগ দেয়? (খ) যোনার পটভূমি সম্বন্ধে আমরা কী জানতে পারি? (এ ছাড়া, পাদটীকা দেখুন।) (গ) একজন ভাববাদী হিসেবে কেন যোনার কাজ সহজ অথবা উপভোগ্য ছিল না?

লোকেরা যখন যোনার সম্বন্ধে চিন্তা করে, তখন তারা প্রায়ই তার নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো, যেমন তার অবাধ্যতা বা এমনকী তার একগুঁয়ে মনোভাবের ওপরই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে বলে মনে হয়। কিন্তু, সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে এর চেয়েও আরও বেশি কিছু আমাদের জানা উচিত। মনে রাখবেন যে, যোনাকে যিহোবা ঈশ্বরের একজন ভাববাদী হিসেবে সেবা করার জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। তিনি যদি অবিশ্বস্ত বা অধার্মিকই হতেন, তাহলে যিহোবা তাকে এইরকম এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য বাছাই করতেন না।

যোনার মধ্যে নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়াও আরও বেশি কিছু ছিল

বাইবেল যোনার পটভূমি সম্পর্কে অল্পই জানায়। (পড়ুন, ২ রাজাবলি ১৪:২৫.) তিনি গাৎহেফরে বাস করতেন, যে-নগরটা নাসরৎ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল, যেখানে প্রায় আট-শো বছর পর যিশুর বড়ো হয়ে ওঠার কথা। * ইস্রায়েলের দশ বংশের রাজা যারবিয়াম ২য়-র রাজত্বের সময়, যোনা ভাববাদী হিসেবে সেবা করেছিলেন। এলিয়ের সময় থেকে বহু বছর কেটে গিয়েছে; তার উত্তরসূরি ইলীশায়, যারবিয়ামের পিতার রাজত্বের সময়ে মারা গিয়েছেন। যদিও বাল উপাসনাকে নির্মূল করার জন্য যিহোবা এই ব্যক্তিদেরকে ব্যবহার করেছিলেন, তবুও ইস্রায়েল আবারও স্বেচ্ছায় বিপথে গিয়েছিল। দেশটা তখন এমন একজন রাজার প্রভাবাধীন ছিল, যিনি “সদাপ্রভুর দৃষ্টিতে যাহা মন্দ . . . তাহাই করিতেন।” (২ রাজা. ১৪:২৪) তাই যোনার কাজটা মোটেও সহজ অথবা উপভোগ্য ছিল না। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বস্তভাবে সেটা পালন করেছিলেন।

কিন্তু, একদিন যোনাকে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তিনি যিহোবার কাছ থেকে এমন এক কার্যভার পেয়েছিলেন, যেটাকে তার কাছে অত্যন্ত কঠিন বলে মনে হয়েছিল। যিহোবা তাকে কী করতে বলেছিলেন?

‘তুমি উঠ, নীনবীতে যাও’

৬. যিহোবা যোনাকে কোন কার্যভার দিয়েছিলেন আর সেই কার্যভারটা তার কাছে কেন কঠিন বলে মনে হয়েছিল?

যিহোবা যোনাকে বলেছিলেন: “তুমি উঠ, নীনবীতে, সেই মহানগরে যাও, আর নগরের বিরুদ্ধে ঘোষণা কর, কেননা তাহাদের দুষ্টতা আমার সম্মুখে উঠিয়াছে।” (যোনা ১:২) এই কার্যভারটা তার কাছে কেন কঠিন বলে মনে হয়েছিল, তা সহজেই বোঝা যায়। নীনবী প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত ছিল আর স্থলপথে সেখানে পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য সম্ভবত এক মাস সময় লাগত। কিন্তু, তার কাছে হয়তো সেই কষ্টকর যাত্রাকে তার কার্যভারের চেয়েও অনেক সহজ বলে মনে হয়েছিল। কারণ নীনবীতে গিয়ে যোনাকে সেই অশূরীয়দের কাছে যিহোবার বিচারবার্তা ঘোষণা করতে হতো, যারা খুবই হিংস্র প্রকৃতির এমনকী নিষ্ঠুর ছিল। যোনা যদি ঈশ্বরের নিজের লোকেদের কাছ থেকেই এত কম সাড়া পেয়ে থাকেন, তাহলে এই পৌত্তলিক লোকদের কাছ থেকে তিনি আর কী-বা আশা করতে পারতেন? যিহোবার এই দাস সেই বিশাল নীনবীতে একা কীভাবে সফল হবেন, যে-নগরকে ‘রক্তপাতী নগর’ বলা হতো?—নহূম ৩:১, ৭.

৭, ৮. (ক) যোনা যিহোবার দেওয়া কার্যভার থেকে পালানোর জন্য কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন? (খ) কেন যোনাকে আমাদের কাপুরুষ বলে চিন্তা করা উচিত নয়?

যোনার মনে হয়তো এই ধরনের চিন্তা এসেছিল। আমরা তা জানি না। আমরা যা জানি তা হল, তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। যিহোবা তাকে পূর্ব দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন; কিন্তু যোনা যতটা পারেন, পশ্চিম দিকে গিয়েছিলেন। তিনি উপকূলের দিকে যাফো নামক একটা বন্দরনগরীতে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি তর্শীশগামী একটা জাহাজ দেখতে পেয়েছিলেন। কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি বলেন যে, তর্শীশ স্পেনে অবস্থিত ছিল। যদি তা-ই হয়, তাহলে যোনা নীনবী থেকে প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার দূরে যাচ্ছিলেন। মহাসমুদ্রের অপর প্রান্ত পর্যন্ত এইরকম এক সমুদ্রযাত্রা করার জন্য হয়তো এক বছর সময় লেগেছিল! যোনা যিহোবার দেওয়া কার্যভার থেকে পালানোর জন্য এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, তিনি এক বছর যাত্রা করতে রাজি ছিলেন!—পড়ুন, যোনা ১:৩.

এর মানে কি এই যে, আমরা যোনাকে একজন কাপুরুষ বলে বাতিল করে দিতে পারি? তার সম্বন্ধে আমাদের এত দ্রুত বিচার করা উচিত নয়। আমরা যেমন দেখব যে, তিনি তার উল্লেখযোগ্য সাহসের জন্য যোগ্য ছিলেন। কিন্তু, আমাদের সবার মতোই যোনাও এমন একজন অসিদ্ধ মানুষ ছিলেন, যিনি দোষত্রুটির সঙ্গে লড়াই করছিলেন। (গীত. ৫১:৫) আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে কখনো ভয়ের সঙ্গে লড়াই করেনি?

৯. যিহোবার কাছ থেকে পাওয়া কার্যভার সম্বন্ধে আমরা কখনো কখনো হয়তো কী মনে করতে পারি আর সেইসময় আমাদের কোন সত্য বিষয়টা মনে রাখা প্রয়োজন?

কখনো কখনো হয়তো মনে হতে পারে যে, আমাদের কাছে যা কঠিন, এমনকী অসম্ভব ঈশ্বর আমাদেরকে তা-ই করতে বলছেন। এমনকী আমরা হয়তো ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করতে ভয় পেতে পারি, যা খ্রিস্টান হিসেবে আমাদের করা আবশ্যক। (মথি ২৪:১৪) আমরা খুব সহজেই যিশুর বলা এই গভীর সত্যকে ভুলে যেতে পারি যে: “ঈশ্বরের সকলই সাধ্য।” (মার্ক ১০:২৭) আমরা যদি মাঝে মাঝে সেই সত্যকে ভুলে যাই, তাহলে আমরা যোনার সমস্যা বুঝতে পারব। কিন্তু, যোনার পালিয়ে যাওয়ার পরিণতি কী হয়েছিল?

যিহোবা তাঁর বিপথগামী ভাববাদীকে শাসন করেন

১০, ১১. (ক) মালবাহী জাহাজটা যখন বন্দর ছেড়েছিল, তখন যোনা হয়তো কী আশা করেছিলেন? (খ) জাহাজ ও এর নাবিকদলের ওপর কোন বিপদ ঘনিয়ে এসেছিল?

১০ আমরা একটু কল্পনা করতে পারি যে, যোনা সেই জাহাজে উঠে পড়েন, যেটা সম্ভবত একটা ফৈনিকীয় মালবাহী জাহাজ ছিল। জাহাজটা যাতে বন্দর ছেড়ে যেতে পারে, সেইজন্য জাহাজের চালক ও নাবিকদল যখন ব্যস্ত ছিল, তখন যোনা তাদের দেখেছিলেন। উপকূলরেখা যখন ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হচ্ছিল ও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, তখন যোনা হয়তো আশা করেছিলেন যে, তিনি যে-বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন, তা থেকে তিনি পালাতে পেরেছেন। কিন্তু হঠাৎ, আবহাওয়া খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

১১ প্রবল বাতাসের কারণে সমুদ্রে ভয়াবহ গর্জন হচ্ছিল, এমন উত্তাল ঢেউ উঠছিল যে, এমনকী সেগুলো আধুনিক দিনের জাহাজকে পর্যন্ত ডুবিয়ে দিতে পারে। প্রকাণ্ড ঢেউয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও ভঙ্গুর বলে মনে হওয়া সেই জাহাজটার কতক্ষণই-বা সময় লাগত? তখন কি যোনা সেই কথাটা জানতেন, যা তিনি পরে লিখেছিলেন—“সদাপ্রভু সমুদ্রে প্রচণ্ড বায়ু পাঠাইয়া দিলেন”? তা বলা কঠিন। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন যে, নাবিকরা তাদের বিভিন্ন দেবতার কাছে কান্নাকাটি করতে শুরু করেছে আর তিনি জানতেন যে, সেইসব মিথ্যা দেবতার কাছ থেকে কোনো সাহায্যই আসবে না। (লেবীয়. ১৯:৪) তার বিবরণ বলে: “জাহাজ ভাঙ্গিয়া যাইবার উপক্রম হইল।” (যোনা ১:৪) আর যোনাই-বা কীভাবে তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারতেন, যাঁর কাছ থেকে তিনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন?

১২. (ক) ঝড় ওঠার সময় যোনা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে কেন আমাদের তাকে ভুলভাবে বিচার করা উচিত নয়? (এ ছাড়া, পাদটীকা দেখুন।) (খ) কীভাবে যিহোবা এই বিপর্যয়ের কারণ প্রকাশ করেছিলেন?

১২ সাহায্য করার ক্ষেত্রে নিজেকে অসহায় মনে করে যোনা জাহাজের পাটাতনের নীচে গিয়ে শোয়ার জন্য একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছিলেন। আর তিনি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। * জাহাজের চালক যোনাকে খুঁজে পেয়ে তাকে ডেকে তুলেছিলেন আর প্রত্যেকে যেমন করছিল, তেমনই তাকেও তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। সেই ঝড়ে যে অতিপ্রাকৃতিক কিছু ব্যাপার ছিল, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যাত্রীদের মধ্যে কে তাদের সমস্যার সম্ভাব্য কারণ, তা দেখার জন্য নাবিকরা গুলিবাঁট করেছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে, গুলিবাঁটে যখন একে একে সবাই বাদ পড়ছিল, তখন যোনার বুক কাঁপতে শুরু করেছিল। শীঘ্র সত্যটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যিহোবাই ঝড় ও সেইসঙ্গে গুলিবাঁটকে একজন ব্যক্তির দিকেই নির্দেশ করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন আর তিনি ছিলেন যোনা।—পড়ুন, যোনা ১:৫-৭.

১৩. (ক) যোনা নাবিকদের কাছে কী স্বীকার করেছিলেন? (খ) যোনা নাবিকদের কী করার জন্য জোর করেছিলেন আর কেন?

১৩ যোনা নাবিকদের সবকিছু খুলে বলেছিলেন। তিনি হলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যিহোবার একজন দাস। সেই ঈশ্বরের কাছ থেকেই তিনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে অসন্তুষ্ট করেছিলেন এবং তাদের সবাইকে চরম বিপদে ফেলেছিলেন। সব শুনে সেই লোকেরা হতবাক হয়ে গিয়েছিল; যোনা তাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ভাব দেখেছিলেন। তারা জিজ্ঞেস করেছিল যে, জাহাজ ও তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা তার প্রতি কী করবে। তিনি তাদেরকে কী বলেছিলেন? সেই উত্তাল সমুদ্রের কনকনে ঠাণ্ডা জলে ডুবে যাওয়ার কথা ভেবে যোনা হয়তো ভয়ে কেঁপে উঠেছিলেন। কিন্তু কী করে তিনি এই লোকেদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারেন, যখন কিনা তিনি জানেন যে, তিনি তাদেরকে বাঁচাতে পারেন? তাই তিনি তাদের জোর করে বলেছিলেন: “আমাকে ধরিয়া সমুদ্রে ফেলিয়া দেও, তাহাতে সমুদ্র তোমাদের পক্ষে ক্ষান্ত হইবে; কেননা আমি জানি আমারই দোষে তোমাদের উপরে এই ভারী ঝড় উপস্থিত হইয়াছে।”—যোনা ১:১২.

১৪, ১৫. (ক) কীভাবে আমরা সবচেয়ে ভালো উপায়ে যোনার বিশ্বাস অনুকরণ করতে পারি? (খ) নাবিকরা যোনার অনুরোধের প্রতি কীভাবে সাড়া দিয়েছিল?

১৪ একজন কাপুরুষ ব্যক্তি নিশ্চয়ই এইরকম কথা বলতে পারেন না, তা-ই নয় কি? সেই ভয়াবহ মুহূর্তে যোনার সাহসী, আত্মত্যাগমূলক মনোভাব দেখা নিশ্চয়ই যিহোবার হৃদয়কে উষ্ণ করেছিল। এখানে আমরা যোনার দৃঢ় বিশ্বাস দেখতে পাই। বর্তমানে আমরা নিজেদের চেয়ে অন্যদের মঙ্গলের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে, তা অনুকরণ করতে পারি। (যোহন ১৩:৩৪, ৩৫) আমরা যখন দেখি যে, কারো কোনো প্রয়োজন রয়েছে, তা সেটা শারীরিক, মানসিক কিংবা আধ্যাত্মিক যা-ই হোক না কেন, আমরা কি সাহায্য করার জন্য নিজেদেরকে বিলিয়ে দিই? আমরা যখন তা করি, তখন আমরা যিহোবাকে কতই-না খুশি করি!

১৫ এই বিষয়টা সম্ভবত সেই নাবিকদের হৃদয়ও স্পর্শ করেছিল, কারণ প্রথমে তারা তা করতে রাজি হয়নি! এর পরিবর্তে, ঝড়ের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যাওয়ার জন্য তারা তাদের যথাসাধ্য করেছিল, কিন্তু কোনো ফলই হয়নি। সেই ঝড় আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল। শেষপর্যন্ত, তারা বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের কাছে আর কোনো উপায় নেই। তাদের প্রতি করুণা দেখানোর জন্য যোনার ঈশ্বর যিহোবাকে ডেকে, তারা যোনাকে ধরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল।—যোনা ১:১৩-১৫.

যোনার অনুরোধে নাবিকেরা তাকে ধরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল

যোনা করুণা ও উদ্ধার লাভ করেন

১৬, ১৭. যোনাকে যখন জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তখন তার কী হয়েছিল তা বর্ণনা করুন? (এ ছাড়া, ছবিগুলো দেখুন।)

১৬ যোনা উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলেন। সম্ভবত, জলের ওপর ভেসে থাকার জন্য তাকে লড়াই করতে হয়েছিল আর তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, ফেনা এবং জলরাশির প্রচণ্ড গর্জনের মধ্যে দিয়ে জাহাজটা দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু, প্রবল ঢেউ তার ওপর আছড়ে পড়ায়, তিনি জলে ডুবে যাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে তলিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার সমস্ত আশা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

১৭ সেইসময় যোনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল, পরে তিনি তা বর্ণনা করেছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে তার মনে বিভিন্ন ছবি ভেসে উঠেছিল। সমুদ্রের তলদেশে, পাহাড়ের পাদদেশের একেবারে কাছাকাছি যাওয়ার অনুভূতি তেমন তা তিনি লাভ করেছিলেন, যেখানে সমুদ্র-শৈবালগুলো তাকে জড়িয়ে ফেলেছিল। সেই জায়গাটা তার কাছে কূপ অর্থাৎ তার কবর বলে মনে হয়েছিল।—পড়ুন, যোনা ২:২-৬.

১৮, ১৯. সমুদ্রগর্ভে যোনার প্রতি কী ঘটেছিল, সেটা কী ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী ছিল আর এইসমস্ত ঘটনার পিছনে কে ছিলেন? (এ ছাড়া, পাদটীকা দেখুন।)

১৮ কিন্তু, একটু দাঁড়ান! কাছেই কিছু একটা ঘোরাঘুরি করছিল, প্রকাণ্ড, কালো, জীবিত কোনোকিছু। সেটা তার দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছিল। একটা বিশাল মুখ তার সামনে খুলে গিয়েছিল ও তাকে গিলে ফেলেছিল!

যিহোবা “যোনাকে গ্রাস করণার্থে একটা বৃহৎ মৎস্য নিরূপণ করিয়াছিলেন”

১৯ এটাই হয়তো তার জীবনের শেষ দিন। অথচ, যোনা আশ্চর্যজনক কিছু অনুভব করেছিলেন। তিনি তখনও বেঁচে ছিলেন! তিনি টুকরো টুকরো হয়ে যাননি, তাকে হজম করাও হয়নি অথবা এমনকী তার দমও বন্ধ হয়ে আসেনি। তখনও তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল, যদিও তিনি সেখানে ছিলেন, যেটা তার কবর হওয়ার কথা ছিল। যোনা ধীরে ধীরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কোনো সন্দেহ নেই যে, যিহোবা ঈশ্বরই “যোনাকে গ্রাস করণার্থে একটা বৃহৎ মৎস্য নিরূপণ করিয়াছিলেন।” *যোনা ১:১৭.

২০. সেই বিরাট মাছের পেটের ভিতরে যোনা যে-প্রার্থনা করেছিলেন, তা থেকে আমরা কী শিখতে পারি?

২০ সময় এগিয়ে যায়, মিনিটের পর মিনিট এবং ঘন্টার পর ঘন্টা। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার যা যোনা আগে কখনো দেখেননি আর সেখানে তিনি চিন্তা করার মতো সময় পেয়েছিলেন এবং যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। তার প্রার্থনা, যা যোনা বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সম্পূর্ণভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, তা অনেক কিছু প্রকাশ করে। এই প্রার্থনা দেখায় যে, শাস্ত্র সম্বন্ধে যোনার বিস্তারিত জ্ঞান ছিল, কারণ সেখানে প্রায়ই গীতসংহিতা থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া, এটা এক হৃদয়গ্রাহী গুণকেও তুলে ধরে, যা হল কৃতজ্ঞতা। যোনা এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন: “আমি তোমার উদ্দেশে স্তবধ্বনি সহ বলিদান করিব; আমি যে মানত করিয়াছি, তাহা পূর্ণ করিব; পরিত্রাণ সদাপ্রভুরই কাছে।”—যোনা ২:৯.

২১. যোনা পরিত্রাণ পাওয়ার ব্যাপারে কী শিখেছিলেন আর আমরা তা থেকে কোন মূল্যবান শিক্ষা পেতে পারি?

২১ ‘মৎস্যের উদরে’ অর্থাৎ সবচেয়ে অস্বস্তিকর একটা জায়গায় বসে যোনা শিখেছিলেন যে, পরিত্রাণ হল এমন কিছু, যা যিহোবা যেকারো জন্য, যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়ে আনতে পারেন। এমনকী সেখানেও যিহোবা তাঁর বিপদগ্রস্ত দাসকে খুঁজে পেয়েছিলেন এবং রক্ষা করেছিলেন। (যোনা ১:১৭) একমাত্র যিহোবাই একজন মানুষকে একটা বিরাট মাছের পেটের ভিতরে তিন দিন ও তিন রাত বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। আজকে, আমাদের পক্ষে এটা মনে রাখা ভালো যে, যিহোবা হলেন ‘সেই ঈশ্বর, আপনার নিঃশ্বাস যাঁহার হস্তগত।’ (দানি. ৫:২৩) আমরা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের অস্তিত্বের জন্য তাঁর কাছে ঋণী। আমরা কি এর জন্য কৃতজ্ঞ? যদি হই, তাহলে আমরাও কি যিহোবার প্রতি বশীভূত থাকতে বাধ্য নই?

২২, ২৩. (ক) কীভাবে যোনার কৃতজ্ঞতার মনোভাব শীঘ্র পরীক্ষিত হয়েছিল? (খ) আমরা যখন কোনো ভুল করি, তখন যোনার কাছ থেকে কী শিখতে পারি?

২২ যোনা সম্বন্ধে কী বলা যায়? তিনি কি বাধ্য হওয়ার দ্বারা যিহোবার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে শিখেছিলেন? হ্যাঁ, তিনি শিখেছিলেন। তিন দিন ও তিন রাত পরে, সেই মাছটা যোনাকে তীরে নিয়ে এসেছিল এবং তাকে ‘শুষ্ক ভূমির উপরে উদ্গীরণ করিয়া দিয়া ছিল।’ (যোনা ২:১০) একটু কল্পনা করুন, এত কিছুর পরে, তীরে আসার জন্য যোনাকে এমনকী সাঁতার পর্যন্ত কাটতে হয়নি! অবশ্য, তাকে সমুদ্রতীর থেকে তার পথ খুঁজে নিতে হয়েছিল, তা সেটা যেখানেই থাকুক না কেন। কিন্তু তার যে কৃতজ্ঞতার মনোভাব ছিল, তা শীঘ্র পরীক্ষিত হয়েছিল। যোনা ৩:১, ২ পদ বলে: “পরে দ্বিতীয় বার সদাপ্রভুর বাক্য যোনার কাছে উপস্থিত হইল; তিনি কহিলেন, তুমি উঠ, নীনবীতে, সেই মহানগরে যাও, আর আমি তোমাকে যাহা ঘোষণা করিতে বলি, তাহা সেই নগরের উদ্দেশে ঘোষণা কর।” যোনা এখন কী করবেন?

২৩ যোনা ইতস্তত করেননি। আমরা পড়ি: “তখন যোনা উঠিয়া সদাপ্রভুর বাক্যানুসারে নীনবীতে গেলেন।” (যোনা ৩:৩) হ্যাঁ, তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। স্পষ্টতই, তিনি তার ভুলগুলো থেকে শিখেছিলেন। এই ক্ষেত্রে আমাদেরও যোনার বিশ্বাস অনুকরণ করতে হবে। আমরা সকলেই পাপ করি; সকলেই ভুল করি। (রোমীয় ৩:২৩) কিন্তু, আমরা কি হাল ছেড়ে দিই, না কি আমরা আমাদের ভুলগুলো থেকে শিখি ও বাধ্যতার সঙ্গে ঈশ্বরকে সেবা করার পথে ফিরে আসি?

২৪, ২৫. (ক) পরিশেষে যোনা তার জীবনকালে কোন পুরস্কার লাভ করেছিলেন? (খ) ভবিষ্যতে যোনার জন্য কোন পুরস্কারগুলো অপেক্ষা করছে?

২৪ যিহোবা কি যোনাকে তার বাধ্যতার জন্য পুরস্কার দিয়েছিলেন? অবশ্যই তিনি দিয়েছিলেন। একটা বিষয় হল, যোনা হয়তো পরিশেষে জানতে পেরেছিলেন যে, সেই নাবিকরা রক্ষা পেয়েছিল। যোনার আত্মত্যাগমূলক কাজের পর সঙ্গেসঙ্গে সেই ঝড় থেমে গিয়েছিল আর সেই নাবিকরা “সদাপ্রভু [“যিহোবা,” NW] হইতে অতিশয় ভীত হইল” এবং তাদের মিথ্যা দেবতাদের পরিবর্তে, তাঁর কাছে বলি উৎসর্গ করেছিল।—যোনা ১:১৫, ১৬.

২৫ অনেক পরে, এর চেয়ে আরও বড়ো এক পুরস্কার এসেছিল। যিশু এক বিরাট মাছের পেটে যোনার থাকার সময়কালকে, তাঁর নিজের কবরে বা পাতালে থাকার সময়কালের এক ভাববাণীমূলক চিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। (পড়ুন, মথি ১২:৩৮-৪০.) যোনা যখন পৃথিবীতে জীবনে পুনরুত্থিত হবেন, তখন তিনি এই বিষয়ে জেনে কতই-না রোমাঞ্চিত হবেন! (যোহন ৫:২৮, ২৯) যিহোবা আপনাকেও আশীর্বাদ করতে চান। যোনার মতো আপনিও কি নিজের ভুলগুলো থেকে শিখবেন ও এক বাধ্য, আত্মত্যাগমূলক মনোভাব দেখাবেন?

^ অনু. 4 গালীল শহরে যোনার জন্ম এক লক্ষণীয় বিষয়, কারণ যিশুকে নির্দেশ করে ফরীশীরা উদ্ধতভাবে বলেছিল: “অনুসন্ধান করিয়া দেখ, গালীল হইতে কোন ভাববাদীর উদয় হয় না।” (যোহন ৭:৫২) অনেক অনুবাদক এবং গবেষক ইঙ্গিত করে যে, ফরীশীরা এই বিষয়ে খুব বেশি বিচারবিবেচনা না করেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, গালীলের মতো একটা অখ্যাত জায়গা থেকে কখনো কোনো ভাববাদী আসেননি বা আসতে পারেন না। যদি তা-ই হয়, তাহলে সেই লোকেরা ইতিহাস ও সেইসঙ্গে ভাববাণীকেও অগ্রাহ্য করছিল।—যিশা. ৯:১, ২.

^ অনু. 12 যোনার ঘুম কতটা গভীর ছিল, সেটার ওপর জোর দিতে গিয়ে সেপ্টুয়াজিন্ট যোগ করে যে, তিনি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন। কিন্তু, যোনার এই ঘুমকে আমরা তার দিক থেকে অন্যদের প্রতি উদাসীনতা হিসেবে বিচার করার পরিবর্তে হয়তো স্মরণ করতে পারি যে, কখনো কখনো ঘুম পাওয়া সেই ব্যক্তিদের মনের অবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে, যারা কোনো কারণে খুবই বিষণ্ণতা বোধ করছে। গেৎশিমানী বাগানে যিশুর কষ্টকর মুহূর্তে পিতর, যাকোব ও যোহন ‘দুঃখ হেতু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন।’—লূক ২২:৪৫.

^ অনু. 19 ‘মৎসের’ জন্য ইব্রীয় শব্দকে যখন গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, তখন সেটাকে “সামুদ্রিক দানব” বা “প্রকাণ্ড মৎস্য” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। যদিও সেটা কী ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী ছিল, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার কোনো উপায় নেই, তবুও দেখা গিয়েছে যে, ভূমধ্যসাগরে এমন হাঙর রয়েছে, যা একটা সম্পূর্ণ মানুষকে গিলে ফেলতে পারে। অন্যান্য জায়গাতে এর চেয়েও বড়ো বড়ো হাঙর রয়েছে; তিমি-জাতীয় হাঙর (হোয়েল শার্ক) লম্বায় প্রায় ১৫ মিটার—সম্ভবত তার চেয়েও দীর্ঘ—হতে পারে!