সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যায় তিন

‘যাহারা বিশ্বাস করে, তাহাদের সকলের পিতা’

‘যাহারা বিশ্বাস করে, তাহাদের সকলের পিতা’

১, ২. নোহের দিনের পর থেকে কীভাবে পৃথিবীর পরিস্থিতি পালটে গিয়েছিল আর এই সম্বন্ধে অব্রাম কেমন বোধ করেছিলেন?

অব্রাম চোখ তুলে তাকাতেই দূরে এক বিশাল মন্দিরের দিকে তার দৃষ্টি চলে যায়, যেটা তার নিজের নগর ঊরে অবস্থিত ছিল। * কোলাহলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল আর সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছিল। চন্দ্রদেবতার উপাসকরা আবারও তাদের বলি উৎসর্গ করছিল। কল্পনা করুন, অব্রাম মুখ ফিরিয়ে মাথা নাড়ছেন আর বিরক্তিতে তার ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছে। লোকের ভিড় ঠেলে রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় তিনি হয়তো চিন্তা করছিলেন যে, প্রতিমাপূজা ঊরের সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে। আর নোহের দিনের পর থেকে পৃথিবীতে মিথ্যা উপাসনা কত ব্যাপকভাবেই না ছড়িয়ে পড়েছে!

অব্রামের জন্মের ঠিক দু-বছর আগে নোহ মারা গিয়েছিলেন। মহাপ্লাবনের পর নোহ ও তার পরিবার যখন জাহাজ থেকে বের হয়ে এসেছিলেন, তখন এই কুলপতি নোহ যিহোবা ঈশ্বরের উদ্দেশে এক বলি উৎসর্গ করেছিলেন আর যিহোবাও এর উত্তরে এক মেঘধনু দেখিয়েছিলেন। (আদি. ৮:২০; ৯:১২-১৪) সেইসময় পৃথিবীতে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ উপাসনা ছিল। কিন্তু এখন অর্থাৎ যে-সময়ে নোহ থেকে দশম প্রজন্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, সেই সময়ে বিশুদ্ধ উপাসকদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। চারিদিকে লোকেরা পৌত্তলিক দেবতাদের উপাসনা করছিল। এমনকী অব্রামের বাবা তেরহ প্রতিমাপূজায় জড়িত ছিলেন, খুব সম্ভবত তিনি মূর্তি তৈরি করতেন।—যিহো. ২৪:২.

কীভাবে অব্রাম বিশ্বাসের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন?

৩. অব্রামের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে কোন গুণটা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছিল আর তা থেকে আমরা কী শিখতে পারি?

অব্রাম একেবারে আলাদা ছিলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিশ্বাসের কারণে অন্যদের সঙ্গে তার পার্থক্য আরও বেশি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছিল। এমনকী পরবর্তীকালে প্রেরিত পৌল অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে এই বলে সম্বোধন করেছিলেন, ‘যাহারা বিশ্বাস করে, তাহাদের সকলের পিতা’! (পড়ুন, রোমীয় ৪:১১.) আসুন আমরা বিবেচনা করে দেখি যে, কীভাবে অব্রাম এইরকম একজন ব্যক্তি হতে শুরু করেছিলেন। আমরা যদি তা করি, তাহলে বিশ্বাস কীভাবে বৃদ্ধি করতে হয়, সেই সম্বন্ধে আমরা নিজেরা অনেক কিছু শিখতে পারব।

জলপ্লাবনের পরবর্তী সময়ে যিহোবাকে সেবা করা

৪, ৫. অব্রাম হয়তো কার কাছ থেকে যিহোবা সম্বন্ধে শিখেছিলেন আর কেন আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি?

অব্রাম কীভাবে যিহোবা ঈশ্বর সম্বন্ধে শিখেছিলেন? আমরা জানি যে, সেই সময়ে যিহোবার বিশ্বস্ত দাসেরা পৃথিবীতে ছিলেন। এইরকম একজন ব্যক্তি ছিলেন শেম। যদিও তিনি নোহের তিন ছেলের মধ্যে বড়ো ছিলেন না, তবুও প্রায়ই তার সম্বন্ধে প্রথমে উল্লেখ করা হয়। সম্ভবত এর কারণ হল, শেমের অসাধারণ বিশ্বাস ছিল। * জলপ্লাবনের কিছু সময় পর, নোহ যিহোবাকে “শেমের ঈশ্বর” বলে উল্লেখ করেছিলেন। (আদি. ৯:২৬) শেম যিহোবা ও বিশুদ্ধ উপাসনার প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন।

অব্রাম কি শেমকে জানতেন? সম্ভবত তিনি তাকে জানতেন। অব্রামকে এক ছোটো ছেলে হিসেবে কল্পনা করুন। এটা জেনে তিনি হয়তো কতই-না আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার এমন একজন পূর্বপুরুষ তখনও জীবিত ছিলেন, যিনি নিজে মানবজাতির চার-শো বছরের ইতিহাসের সাক্ষি! শেম জলপ্লাবনের পূর্বের মন্দতা, পৃথিবীকে দুষ্টতা মুক্ত করেছিল এমন এক মহাপ্লাবন, পৃথিবীতে প্রথম মানবসমাজের বৃদ্ধি আর বাবিলের দুর্গে নিম্রোদের বিদ্রোহের অন্ধকারময় দিন, এই সমস্তকিছু নিজের চোখে দেখেছিলেন। বিশ্বস্ত শেম সেই বিদ্রোহে যোগ দেননি, তাই যিহোবা যখন দুর্গ নির্মাণকারীদের মধ্যে ভাষাভেদ করেছিলেন, তখন শেম ও তার পরিবার মানবজাতির প্রথম ভাষায় কথা বলত, যে-ভাষায় নোহ কথা বলতেন। অব্রামও এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাই অব্রাম নিশ্চয়ই শেমের প্রতি উচ্চ সম্মান নিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, অব্রামের দীর্ঘ জীবনকালের বেশিরভাগ সময় পর্যন্ত শেম জীবিত ছিলেন। তাই অব্রাম সম্ভবত শেমের কাছ থেকে যিহোবা সম্বন্ধে শিখেছিলেন।

অব্রাম ঊরে ছড়িয়ে থাকা প্রতিমাপূজা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন

৬. (ক) কীভাবে অব্রাম দেখিয়েছিলেন যে, তিনি জলপ্লাবনের ঘটনা থেকে একটা বড়ো শিক্ষা লাভ করেছিলেন? (খ) একত্রে অব্রাম ও সারীর জীবনযাত্রা কেমন ছিল?

যা-ই হোক না কেন, অব্রাম জলপ্লাবনের ঘটনা থেকে একটা বড়ো শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি নোহের মতো ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন করার জন্য যথাসাধ্য করেছিলেন। সেই কারণে তিনি প্রতিমাপূজা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আর ঊর নগরে এমনকী হয়তো নিজের পরিবারের মধ্যেও ভিন্ন ছিলেন। কিন্তু, তিনি একজন চমৎকার জীবনসাথি খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি সারীকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি শুধুমাত্র সৌন্দর্যের দিক দিয়েই নন, কিন্তু সেইসঙ্গে যিহোবার প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাসের কারণেও অসাধারণ ছিলেন। * যদিও তাদের কোনো সন্তান ছিল না, তবুও কোনো সন্দেহ নেই যে, সেই দম্পতি একত্রে যিহোবাকে সেবা করার ক্ষেত্রে অনেক আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। এ ছাড়া, তারা অব্রামের অনাথ ভাইপো লোটকে বড়ো করে তুলেছিলেন।

৭. যিশুর অনুসারীদের কীভাবে অব্রামের বিশ্বাস অনুসরণ করা উচিত?

ঊরে প্রচলিত প্রতিমাপূজার কারণে অব্রাম কখনো যিহোবাকে পরিত্যাগ করেননি। তিনি ও সারী নিজেদেরকে সেই প্রতিমাপূজায় লিপ্ত সমাজ থেকে আলাদা করে রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন। আমরা যদি প্রকৃত বিশ্বাস গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদেরও একইরকম মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। আমাদেরও আলাদা হওয়ার জন্য ইচ্ছুক হতে হবে। যিশু বলেছিলেন যে, তাঁর অনুসারীরা ‘জগতের নহে’ আর তাই জগৎ তাদের ঘৃণা করবে। (পড়ুন, যোহন ১৫:১৯.) আপনি যদি কখনো যিহোবাকে সেবা করার বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্তের জন্য আপনার পরিবার অথবা আপনার সমাজের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হন, তাহলে মনে রাখবেন যে, আপনি একা নন। আপনি অব্রাম ও সারীর ভালো উদাহরণ অনুকরণ করছেন, যারা বিশ্বস্তভাবে যিহোবাকে সেবা করেছিলেন।

“তুমি স্বদেশ হইতে . . . বাহির হও”

৮, ৯. (ক) অব্রাম এমন কোন অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, যা তিনি কখনো ভুলতে পারেননি? (খ) যিহোবা অব্রামকে কোন বার্তা জানিয়েছিলেন?

একদিন অব্রাম এমন এক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, যা তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। তিনি যিহোবা ঈশ্বরের কাছ থেকে এক বার্তা পেয়েছিলেন! বাইবেল এই বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছু জানায় না, কিন্তু এটা জানায় যে, “প্রতাপের ঈশ্বর” সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। (পড়ুন, প্রেরিত ৭:২, ৩.) খুব সম্ভবত, প্রতিনিধি হিসেবে একজন স্বর্গদূতের মাধ্যমে অব্রাম এই বিশ্বের সার্বভৌম প্রভুর অসাধারণ প্রতাপের এক ঝলক দেখেছিলেন। আমরা কল্পনা করতে পারি যে, অব্রাম সেই জীবন্ত ঈশ্বর ও অব্রামের সমসাময়িক লোকেরা যে-নিষ্প্রাণ প্রতিমাগুলোর উপাসনা করত, সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য দেখে কতই-না রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন!

যিহোবা অব্রামকে কোন বার্তা জানিয়েছিলেন? “তুমি স্বদেশ হইতে ও আপন জ্ঞাতি কুটুম্বদের মধ্য হইতে বাহির হও, এবং আমি যে দেশ তোমাকে দেখাই, সেই দেশে চল।” যিহোবার মনে কোন দেশ ছিল, তা তিনি জানাননি, তিনি শুধু জানিয়েছিলেন যে, তিনি অব্রামকে সেই দেশ দেখাবেন। কিন্তু, প্রথমে অব্রামকে তার নিজের দেশ ও আত্মীয়স্বজনকে ছেড়ে যেতে হবে। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি অনুসারে পরিবারকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হতো। একজন ব্যক্তির পক্ষে আত্মীয়স্বজনকে ছেড়ে দূরে চলে যাওয়াকে প্রায়ই দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করা হতো; কারো কারো কাছে তা মৃত্যুর চেয়েও দুঃখজনক হতো!

১০. কেন অব্রাম ও সারীর পক্ষে ঊরে তাদের নিজস্ব বাড়ি ছেড়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল?

১০ ঊরের আরামআয়েশ ছেড়ে যাওয়া অব্রামের পক্ষে খুব কঠিন ছিল। স্পষ্টতই, ঊর এক কর্মব্যস্ত ও সমৃদ্ধশালী নগর ছিল। (“ অব্রাম ও সারী যে-নগর ত্যাগ করেছিলেন” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।) প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো প্রকাশ করে যে, প্রাচীন ঊরে বাড়িগুলো ছিল খুব আরামদায়ক; কিছু কিছু বাড়িতে পরিবার ও দাস-দাসীর জন্য বারোটা বা তারও বেশি ঘর থাকত আর মাঝখানে পাথর দিয়ে বাঁধানো উঠোন থাকত। জল সরবরাহ, শৌচাগার ও বর্জ্য নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা ছিল। এটা মনে রাখুন যে, অব্রাম ও সারী দু-জনেরই বয়স হয়েছিল; সম্ভবত অব্রামের বয়স ছিল ৭০-এর কোঠায় আর সারীর বয়স ৬০-এর কোঠায়। তিনি নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন যেন তার স্ত্রী উপযুক্ত যত্ন ও আরাম পেতে পারেন—যেটা যেকোনো ভালো স্বামী তার স্ত্রীর জন্য চান। তাদের মনে যে-প্রশ্ন ও উদ্‌বেগ ছিল, সেগুলো নিয়ে তারা পরস্পরের মধ্যে যা আলোচনা করেছিলেন, সেগুলো সম্বন্ধে চিন্তা করুন। সারী যখন এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, তখন অব্রাম নিশ্চয়ই অনেক খুশি হয়েছিলেন! অব্রামের মতো তিনিও তার ঘরের সমস্ত আরামআয়েশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন।

১১, ১২. (ক) ঊর ছেড়ে যাওয়ার আগে অব্রাম ও সারীকে কোন কোন প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল? (খ) তারা যে-দিন যাত্রা শুরু করেছিল, সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা করুন।

১১ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অব্রাম ও সারীকে অনেক কাজ করতে হয়েছিল। তাদের অনেক কিছু গোছানো এবং বিভিন্ন কাজ সংগঠিত করা বাকি ছিল। অজানার উদ্দেশে এই যাত্রার জন্য তারা সঙ্গে কী নেবেন আর কী ছেড়ে যাবেন? কিন্তু সবচেয়ে বড়ো বিষয়টা হল, তাদের পরিবারের লোকেদের কী হবে। বয়স্ক তেরহকে নিয়ে তারা কী করবেন? তারা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার এবং বাকি জীবন তার দেখাশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি হয়তো আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিলেন, কারণ বিবরণ এই বলে তেরহের প্রশংসা করে যে, তিনি কুলপতি হিসেবে তার পরিবারকে নিয়ে ঊর ত্যাগ করেছিলেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি প্রতিমাপূজা পরিত্যাগ করেছিলেন। অব্রামের ভাইপো লোটও তাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন।—আদি. ১১:৩১.

১২ পরিশেষে, বিদায় নেওয়ার সময় উপস্থিত হয়েছিল। কল্পনা করুন, তারা দলগতভাবে ঊরের প্রাচীর ও পরিখার বাইরে একত্রিত হচ্ছেন। উট ও গাধার ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে, পশুপাল একত্রিত করা হচ্ছে, পরিবারের সকলে ও দাস-দাসীরা উপস্থিত আর সবাই অপেক্ষা করে রয়েছে যে, কখন তারা রওনা দেবে। * সকলে হয়তো অব্রামের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কখন তিনি যাওয়ার অনুমতি দেবেন। অবশেষে সেই মুহূর্ত এসেছিল, যখন তারা চিরকালের জন্য ঊর ছেড়ে যাত্রা শুরু করবে।

১৩. বর্তমানে কীভাবে যিহোবার অনেক দাস অব্রাম ও সারীর মতো মনোভাব দেখিয়ে থাকেন?

১৩ বর্তমানেও যিহোবার অনেক দাস, যেখানে রাজ্যের প্রচারকদের বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যেরা তাদের পরিচর্যাকে বৃদ্ধি করার জন্য নতুন ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিংবা তারা ব্যক্তিগত আরামআয়েশ ত্যাগ করে সেবা করার অন্য উপায় বেছে নিয়েছেন। এই ধরনের সিদ্ধান্তের পিছনে সাধারণত ত্যাগস্বীকার অর্থাৎ কিছু মাত্রায় বস্তুগত আরামআয়েশ ত্যাগ করার জন্য ইচ্ছুক মনোভাব প্রয়োজন। এই ধরনের মনোভাব কতই-না প্রশংসনীয়, যা অব্রাম ও সারীর মনোভাবের সঙ্গে একেবারে মিলে যায়! আমরা যদি এইরকম বিশ্বাস দেখাই, তাহলে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, আমরা যিহোবাকে যতটা দিয়ে থাকি, তার চেয়ে তিনি আমাদেরকে সবসময় অনেক বেশি দেবেন। তিনি অবশ্যই বিশ্বাসকে পুরস্কৃত করবেন। (ইব্রীয় ৬:১০; ১১:৬) তিনি কি অব্রামের জন্য তা করেছিলেন?

ফরাৎ নদী অতিক্রম করা

১৪, ১৫. ঊর থেকে হারণের যাত্রা কেমন ছিল আর কেন হয়তো অব্রাম হারণে কিছু কাল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

১৪ অভিযাত্রীদের দল যাত্রা করতে করতে একসময় এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমরা হয়তো কল্পনা করতে পারি যে, অব্রাম ও সারী পালাক্রমে একবার হাঁটছেন আর একবার পশুর পিঠে উঠছেন, তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছেন আর সেইসঙ্গে পশুদের গলায় ঝোলানো ঘন্টির শব্দও শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে, এমনকী সবচেয়ে কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যাত্রীরাও তাঁবু খাটাতে ও খুলে নিতে আর বয়স্ক তেরহকে উট অথবা গাধার পিঠে ভালোভাবে বসতে সাহায্য করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তারা ফরাৎ নদী ধরে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাত্রা করেছিলেন। দিনের পর দিন ও সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল আর তারা ধীরে ধীরে অনেকটা পথ অতিক্রম করেছিলেন।

১৫ শেষে প্রায় ৯৬০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর, তারা হারণে অবস্থিত মৌচাক আকৃতির ছোটো ছোটো ঘরের কাছে এসে পৌঁছেছিলেন, যেটা ছিল পূর্ব-পশ্চিমে যাওয়ার বাণিজ্যপথের সংযোগস্থলে অবস্থিত এক সমৃদ্ধশালী নগর। পরিবারটা সেখানে থেমেছিল আর কিছু সময়ের জন্য সেখানেই ছিল। খুব সম্ভবত, তেরহ হয়তো এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি আর যাত্রা করতে পারছিলেন না।

১৬, ১৭. (ক) কোন চুক্তি অব্রামের জন্য রোমাঞ্চকর ছিল? (খ) হারণে থাকাকালীন যিহোবা কীভাবে অব্রামকে আশীর্বাদ করেছিলেন?

১৬ একসময়, ২০৫ বছর বয়সে তেরহ মারা গিয়েছিলেন। (আদি. ১১:৩২) এই শোকের সময় অব্রাম অনেক সান্ত্বনা পেয়েছিলেন, যখন যিহোবা আবার তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। যিহোবা ঊরে যে-নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলো আবারও তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এবং আরও কিছু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। অব্রামের কাছ থেকে এক মহাজাতি উৎপন্ন হবে আর তার দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত জাতি আশীর্বাদপ্রাপ্ত হবে। (পড়ুন, আদিপুস্তক ১২:২, ৩.) অব্রাম ও ঈশ্বরের মধ্যে এই চুক্তি তাকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিল।

১৭ কিন্তু এই সময়, তাকে আরও অনেক কিছু গোছাতে হয়েছিল কারণ হারণে থাকাকালীন যিহোবা তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। “হারণে তাঁহারা যে ধন উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, ও যে প্রাণিগণকে লাভ করিয়াছিলেন” বিবরণ সেই বিষয়ে উল্লেখ করে। (আদি. ১২:৫) এক মহাজাতি হয়ে ওঠার জন্য অব্রামের বস্তুগত বিষয়সম্পত্তি ও অনেক দাস-দাসী অর্থাৎ এক বড়ো পরিবারের প্রয়োজন ছিল। যিহোবা যে সবসময় তাঁর দাসদের ধনসম্পদ দেন এমন নয়, কিন্তু তাঁর ইচ্ছা সম্পাদন করার জন্য তাদের যা প্রয়োজন, তা তিনি দেন। তাই আরও শক্তিশালী হয়ে অব্রাম সেই দলকে নিয়ে এক অজানা উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন।

অব্রাম ও সারীর পক্ষে ঊরে তাদের আরামআয়েশ ছেড়ে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বরূপ ছিল

১৮. (ক) কখন অব্রাম সেই চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, যা ইতিহাসজুড়ে তাঁর লোকেদের সঙ্গে যিহোবার আচরণের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল? (খ) পরবর্তীকালে ১৪ নিশান তারিখে আর কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল? (“ বাইবেলের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ” শিরোনামের বাক্সটা দেখুন।)

১৮ হারণ থেকে কয়েক দিনের দূরত্বে কর্কমীশ অবস্থিত, যেখানে সাধারণত যাত্রীরা ফরাৎ নদী অতিক্রম করত। খুব সম্ভবত, এই স্থানেই অব্রাম এমন এক চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, যা ইতিহাসজুড়ে তাঁর লোকেদের সঙ্গে যিহোবার আচরণের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। স্পষ্টতই, অব্রাম যে-দিন তার দল নিয়ে নদী পার হয়েছিলেন, সেটা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৯৪৩ সাল এবং মাসের ১৪তম দিন, যে-মাসকে পরবর্তীকালে নিশান মাস বলা হতো। (যাত্রা. ১২:৪০-৪৩) দক্ষিণ দিকে ছিল সেই দেশ, যেটা অব্রামকে দেখাবেন বলে যিহোবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেই দিন অব্রামের সঙ্গে করা ঈশ্বরের চুক্তি কার্যকর হতে শুরু করেছিল।

১৯. অব্রামের কাছে করা যিহোবার প্রতিজ্ঞায় কীসের উল্লেখ ছিল আর এটা হয়তো অব্রামকে কী স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল?

১৯ অব্রাম দেশের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করছিলেন আর অভিযাত্রীদের সেই দল শিখিমে মোরির বড়ো গাছের কাছে থেমেছিল। সেখানে যিহোবা আরেক বার অব্রামের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এই বারে ঈশ্বর ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিলেন যে, অব্রামের বংশ বা সন্তান সেই দেশ অধিকার করবে। সেই সময় অব্রাম কি এদনে করা যিহোবার ভবিষ্যদ্‌বাণীর বিষয়ে স্মরণ করেছিলেন, যেখানে এমন এক “বংশ” বা বংশধর সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল, যিনি একদিন মানবজাতিকে উদ্ধার করবেন? (আদি. ৩:১৫; ১২:৭) হয়তো তিনি স্মরণ করেছিলেন। অস্পষ্টভাবে হলেও তিনি তখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন যে, তিনি সেই মহান উদ্দেশ্যের এক অংশ, যেটা যিহোবা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।

২০. যিহোবা অব্রামকে যে-বিশেষ সুযোগ দিয়েছিলেন, তিনি সেটার জন্য কীভাবে উপলব্ধি দেখিয়েছিলেন?

২০ যিহোবা অব্রামকে যে-বিশেষ সুযোগ দিয়েছিলেন, তিনি সেটার জন্য গভীর উপলব্ধি দেখিয়েছিলেন। তিনি যখন সেই দেশের মধ্যে ভ্রমণ করছিলেন—নিঃসন্দেহে খুবই সতর্কতার সঙ্গে, কারণ তখনও সেখানে কনানীয়রা বাস করত—তখন অব্রাম প্রথমে মোরির বড়ো গাছের কাছে ও পরে বৈথেলে যিহোবার উদ্দেশে যজ্ঞবেদি নির্মাণ করেছিলেন। খুব সম্ভবত, তার ভাবী সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার সময় তার ঈশ্বরকে হৃদয় থেকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য, তিনি যিহোবার নাম ধরে তাঁকে ডেকেছিলেন। তিনি হয়তো তার কনানীয় প্রতিবেশীদের কাছে প্রচারও করেছিলেন। (পড়ুন, আদিপুস্তক ১২:৭, ৮.) এটা ঠিক যে, অব্রামের বিশ্বাসের বড়ো বড়ো পরীক্ষা তখনও আসা বাকি ছিল। বিজ্ঞতার সঙ্গে অব্রাম ঊরে ছেড়ে আসা বাড়ি ও আরামআয়েশের প্রতি ফিরে তাকাননি। তিনি ভবিষ্যতের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। অব্রামের বিষয়ে ইব্রীয় ১১:১০ পদ বলে, “তিনি ভিত্তিমূলবিশিষ্ট সেই নগরের অপেক্ষা করিতেছিলেন, যাহার স্থাপনকর্ত্তা ও নির্ম্মাতা ঈশ্বর।”

২১. ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের সঙ্গে কীভাবে অব্রামের জ্ঞানের তুলনা করা যায় আর তা আপনাকে কী করতে পরিচালিত করে?

২১ আজকে আমরা যারা যিহোবার সেবা করি, আমরা অব্রামের চেয়ে সেই রূপক নগর অর্থাৎ ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি। আমরা জানি যে, সেই রাজ্য স্বর্গে শাসন করছে আর খুব শীঘ্র এই বিধিব্যবস্থার শেষ নিয়ে আসবে। আমরা এও জানি যে, অব্রামের কাছে করা সেই দীর্ঘ প্রতিজ্ঞাত বংশ যিশু খ্রিস্ট এখন সেই রাজ্য শাসন করছেন। এটা দেখা আমাদের কাছে কতই-না বড়ো এক সুযোগ বলে প্রমাণিত হবে, যখন অব্রাহাম আবার জীবিত হবেন আর শেষপর্যন্ত সেই ঐশিক উদ্দেশ্য তার কাছে স্পষ্ট হবে, যা এক সময় তার কাছে অস্পষ্ট ছিল! যিহোবা যখন তাঁর করা প্রত্যেকটা ভবিষ্যদ্‌বাণী পরিপূর্ণ করবেন, তখন তা কি আপনি দেখতে চাইবেন না? তাই অব্রাম যা করেছিলেন, তা করার জন্য যথাসাধ্য করে চলুন। আত্মত্যাগের মনোভাব, বাধ্যতা এবং যিহোবা আপনাকে যে-সুযোগ প্রদান করেছেন, সেটার প্রতি প্রার্থনাপূর্ণ উপলব্ধি দেখান। আপনি যখন অব্রামের বিশ্বাস অনুকরণ করেন, যিনি ‘যাহারা বিশ্বাস করে, তাহাদের সকলের পিতা’, তখন এক অর্থে তিনি আপনারও পিতা হয়ে উঠবেন!

^ অনু. 1 অনেক বছর পর, ঈশ্বর অব্রামের নাম পরিবর্তন করে অব্রাহাম রেখেছিলেন, যেটার অর্থ “বহুলোকের পিতা।”—আদি. ১৭:৫.

^ অনু. 4 একইভাবে, অব্রামকে প্রায়ই তেরহের ছেলেদের মধ্যে প্রথমে উল্লেখ করা হয়, যদিও তিনি সবচেয়ে বড়ো ছিলেন না।

^ অনু. 6 পরবর্তীকালে ঈশ্বর সারীর নাম পরিবর্তন করে সারা রেখেছিলেন, যেটার অর্থ “রাণী।”—আদি. ১৭:১৫.

^ অনু. 12 কিছু কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি সেই বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন যে, অব্রামের সময় উটকে পোষ মানানো হতো কি না। কিন্তু, এই ধরনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বাইবেল বেশ কয়েক বার উল্লেখ করে যে, অব্রামের বিষয়সম্পত্তির মধ্যে উটও ছিল।—আদি. ১২:১৬; ২৪:৩৫.