সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

প্রচ্ছদ বিষয়

আপনি কি অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন?

আপনি কি অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন?

আপনাকে কি অনেক কাজ করতে হয়? যদি তা-ই হয়, তা হলে আপনি একা নন। দি ইকনমিস্ট  পত্রিকার একটা রিপোর্ট জানায়, “সব জায়গায় সমস্ত লোকই মনে হয় ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছে।”

দু-হাজার পনেরো সালে আটটা দেশে একটা সমীক্ষা করা হয়েছিল। এই সমীক্ষা অনুযায়ী, পূর্ণ সময়ের চাকরি করে এমন লোকেদের মধ্যে অনেকে এই মন্তব্য করেছিল যে, তাদের কাজ ও তাদের পারিবারিক জীবনের চাহিদা একসঙ্গে মেটাতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে। এর পিছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে যেমন, কাজের জায়গায় কিংবা পরিবারে অতিরিক্ত দায়িত্ব, খরচের বৃদ্ধি ও বেশি ঘণ্টা কাজ করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে পূর্ণসময়ের কর্মীরা বলে থাকে, তারা সপ্তাহে গড়ে ৪৭ ঘণ্টা কাজ করে। প্রায় ৫ জনের মধ্যে ১ জন দাবি করেন, তাকে ৬০ বা তারও বেশি ঘণ্টা কাজ করতে হয়।

৩৬টা দেশে আরেকটা সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষায় মন্তব্যকারী এক চতুর্থাংশ লোক জানায় যে, এমনকী ছুটির সময়ও তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। এ ছাড়া, সন্তানদের উপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিলে তারাও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়।

নির্দিষ্ট সময়ে যতটা কাজ করা সম্ভব, আমরা যখন নিয়মিতভাবে সেটার চেয়ে বেশি করার চেষ্টা করি, তখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি আর “সময়ের চাপ” নামক মানসিক চাপের শিকার হই। কিন্তু প্রশ্ন হল, এর চেয়ে আরও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে জীবনযাপন করা কি সম্ভব? এই ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাস, মনোনয়ন ও লক্ষ্যের কোন ভূমিকা রয়েছে? আসুন, প্রথমে আমরা চারটে কারণ বিবেচনা করে দেখি, কেন কেউ কেউ অতিরিক্ত কাজ করার প্রচেষ্টা করে।

১ ভালোভাবে পরিবারের ভরণ-পোষণ জোগানোর আকাঙ্ক্ষা

গ্যারি নামে একজন বাবা বলেন, “আমি সপ্তাহে সাত দিন কাজ করতাম। আমি তা করতাম কারণ আমি সবসময় আমার সন্তানদের আরও ভালো কিছু দিতে চাইতাম। আমি তাদের সেই জিনিসগুলো দিতে চাইতাম, যেগুলো আমি নিজে কখনো পাইনি।” ভালো অভিপ্রায় থাকা সত্ত্বেও বাবা-মায়েদের উচিত, নিজেদের অগ্রাধিকারের বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখা। কিছু গবেষণা দেখায়, যে-প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা ও সন্তানরা বস্তুবাদী নয়, তাদের চেয়ে যারা টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তিকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তারা কম সুখী হয়, জীবনে ততটা পরিতৃপ্তি খুঁজে পায় না এবং শারীরিকভাবেও কম সুস্থ থাকে।

যে-সন্তানরা বস্তুগত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বড়ো হয়, তারা আসলে কম সুখী হয়

ভবিষ্যতে ছেলে-মেয়েরা যাতে তাদের জীবনে সফল হতে পারে, সেইজন্য কোনো কোনো বাবা-মা তাদের সন্তানদের বিভিন্ন কাজকর্মে অতিরিক্ত ব্যস্ত রাখে আর নিজেরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে সন্তান ও বাবা-মা উভয়ই সমস্যা ভোগ করে।

২ এমনটা বিশ্বাস করা হয়, ‘আরেকটু বেশি হলে আরও ভালো’

বিজ্ঞাপনদাতারা আমাদের এমনটা বিশ্বাস করাতে চায়, আমরা যদি তাদের সর্বাধুনিক সামগ্রী না কিনি, তা হলে আমরা নিজেদের বঞ্চিত করছি। দি ইকনমিস্ট পত্রিকা জানায়: “এখন এত রাশি রাশি জিনিসপত্র পাওয়া যায় যে, লোকেরা মনে করে তাদের হাতে উপভোগ করার মতো যথেষ্ট সময় নেই।” ক্রেতা হিসেবে তাদের হাতে থাকা অল্পসময়ের মধ্যে তারা “কোন জিনিস কিনবে, কী দেখবে কিংবা কী খাবে, তা বাছাই করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায়।”

১৯৩০ সালে একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিলেন, প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে লোকেদের হাতে ছুটি কাটানোর জন্য আরও বেশি সময় থাকবে। তার ভবিষ্যদ্‌বাণী কতই-না ভুল ছিল! নিউ ইয়র্কার পত্রিকার একজন লেখিকা এলিজাবেথ কলবার্ট লক্ষ করেন: “কাজ থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে লোকেরা নতুন নতুন জিনিসপত্র কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তা তাদের টাকাপয়সা ও সময় কেড়ে নেয়।”

৩ অন্যদের চাহিদা মেটানোর প্রচেষ্টা

কোনো কোনো কর্মী তাদের কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। সহকর্মীরাও তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে; তারা যদি কাজের পর বেশি সময় না থাকে, তা হলে সমালোচনার পাত্র হয়ে পড়ে। এ ছাড়া রয়েছে আর্থিক অনিশ্চয়তা। ফলে, লোকেরা অনেক ঘণ্টা কাজ করতে ও যেকোনো সময়ে কাজে যেতে রাজি হয়।

একইভাবে, বাবা-মায়েরা অন্যান্য পরিবারের ব্যস্ত তালিকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চাপ অনুভব করতে পারে। তা না হলে, তারা হয়তো এই মনে করে নিজেদের দোষারোপ করে যে, তারা সন্তানদের ‘বঞ্চিত করছে।’

৪ পদমর্যাদা ও ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা লাভের পিছনে ছোটা

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত টিম বলেন: “আমি কাজ করতে ভালোবাসতাম এবং আমি সবসময় প্রচুর পরিশ্রম করতাম। আমি কী ধরনের ব্যক্তি, তা প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম।”

টিমের মতো অনেকেই মনে করে, নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখা ও কাজের বোঝা বহন করার মধ্যে এক দৃঢ় সংযোগ রয়েছে। এর ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে? আগে উল্লেখিত এলিজাবেথ কলবার্ট বলেন, “ব্যস্ত থাকা সামাজিক পদমর্যাদা লাভ করেছে।” তিনি আরও বলেন: “আপনি যত ব্যস্ত থাকবেন, তত মনে হবে আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি।”

ভারসাম্য বজায় রাখতে শিখুন

বাইবেল অধ্যবসায়ী হতে ও কঠোর পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করে। (হিতোপদেশ ১৩:৪) কিন্তু এটি ভারসাম্য বজায় রাখতেও পরামর্শ দেয়। উপদেশক ৪:৬ পদ বলে, “পরিশ্রম ও বায়ুভক্ষণসহ পূর্ণ দুই মুষ্টি অপেক্ষা শান্তিসহ পূর্ণ এক মুষ্টি ভাল।”

ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করা আমাদের মন ও শরীর উভয়ের জন্য ভালো। কিন্তু, কাজ কমিয়ে দেওয়া বা অতিরিক্ত ব্যস্ত না থাকা কি আসলেই সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। আসুন চারটে পরামর্শ বিবেচনা করে দেখি:

১ আপনার মূল্যবোধ ও লক্ষ্য নির্ধারণ করুন

কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা আশা করা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু, তা লাভ করার জন্য কতটা টাকাপয়সার প্রয়োজন? সফলতা বলতে কী বোঝায়? এটা কি শুধু আয়ের পরিমাণ কিংবা বস্তুগত সম্পদ দিয়ে পরিমাপ করা যায়? বিপরীত দিকে, খুব বেশি বিশ্রাম নেওয়া অথবা আমোদপ্রমোদে লিপ্ত থাকা সময়ের চাপকে বাড়িয়ে দিতে পারে।

আগে উল্লেখিত টিম মন্তব্য করেন: “আমার স্ত্রী ও আমি আমাদের জীবন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি আর তারপর সাদাসিধেভাবে জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের নতুন লক্ষ্যগুলো নিয়ে আমরা একটা তালিকা তৈরি করি। পূর্বে নেওয়া আমাদের সিদ্ধান্তগুলো আমাদের উপর যে-প্রভাব ফেলেছিল আর সেইসঙ্গে আমাদের লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছানোর জন্য আমাদের কী কী প্রয়োজন, সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি।”

২ আনন্দ পাওয়ার জন্য কেনাকাটা করার প্রবণতা কমিয়ে দিন

বাইবেল আমাদের ‘চক্ষুর অভিলাষকে’ নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেয়। (১ যোহন ২:১৫-১৭) বিভিন্ন বিজ্ঞাপন এই অভিলাষকে বাড়িয়ে তোলে আর এটা একজন ব্যক্তিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করার দিকে কিংবা অতিরিক্ত অথবা ব্যয়বহুল আমোদপ্রমোদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এটা ঠিক, আপনি হয়তো সমস্ত বিজ্ঞাপন এড়াতে পারবেন না। কিন্তু, আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এ ছাড়া, আপনি ভালোভাবে বিবেচনা করতে পারেন, কোন জিনিসগুলো আপনার সত্যিই প্রয়োজন।

মনে রাখবেন, আপনি যাদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, তারাও আপনার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তারা যদি বস্তুগত বিষয়ের পিছনে ছোটে অথবা মনে করে, সেগুলো লাভ করাই একজন ব্যক্তিকে সফল করে তোলে, তা হলে এমন বন্ধুদের খুঁজে বের করা বিজ্ঞতার কাজ হবে, যাদের মধ্যে এই ধরনের লক্ষ্য নেই। বাইবেল জানায়, “জ্ঞানীদের সহচর হও, জ্ঞানী হইবে।”—হিতোপদেশ ১৩:২০.

৩ কাজের ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করুন

আপনি কতটা কাজ করতে চান এবং কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেন, তা নিয়ে আপনার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলুন। কাজের বাইরেও যে আপনার জীবন রয়েছে, এমনটা চিন্তা করা দোষের কিছু নয়। ওয়ার্ক টু লিভ নামক একটা বই বলে: “যারা কাজ ও পরিবারের মধ্যে একটা সীমারেখা আরোপ করে অথবা ছুটি নেয়, তারা সবসময় এই বিষয়টা আবিষ্কার করে: আপনি ছুটি নিলে পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যায় না।।”

আগে উল্লেখিত গ্যারির টাকাপয়সার অভাব ছিল না আর তাই তিনি কাজের সময় কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানান, “আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলি এবং আমাদের জীবনকে সাদাসিধে করার প্রস্তাব দিই। এরপর তা করার জন্য আমরা ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিই। এ ছাড়া, আমি আমার কর্মকর্তাকে প্রত্যেক সপ্তাহে আগের চেয়ে অল্প দিন কাজ করার প্রস্তাব দিই আর তিনি এতে রাজি হন।”

৪ পরিবারের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করাকে অগ্রাধিকার দিন

স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের সঙ্গে সময় কাটানো প্রয়োজন এবং সন্তানদেরও তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটানো প্রয়োজন। আর তাই, এমন পরিবারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রচেষ্টা করবেন না, যারা সবসময় ব্যস্ত থাকে। গ্যারি পরামর্শ দেন, “বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য সময় আলাদা করে রাখুন এবং সেই কাজগুলো করা এড়িয়ে চলুন, যেগুলোর খুব-একটা প্রয়োজন নেই।”

পরিবারগতভাবে যখন আপনারা একসঙ্গে থাকেন, তখন টেলিভিশন, মোবাইল ফোন কিংবা অন্যান্য ডিভাইস যেন আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে না রাখে। প্রত্যেক দিন অন্ততপক্ষে এক বার একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করুন এবং খাওয়ার সময় একে অন্যের সঙ্গে কথা বলুন। যখন বাবা-মায়েরা এই সহজসরল পরামর্শ মেনে চলেন, তখন তাদের সন্তানরা আরও ভালোভাবে জীবন উপভোগ করে এবং স্কুলে ভালো ফল নিয়ে আসে।

খাওয়ার সময় একে অন্যের সঙ্গে কথা বলুন

পরিশেষে, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: ‘আমি জীবনে কী পেতে চাই? আমি আমার পরিবারের জন্য কী চাই?’ আপনি যদি আরও সুখী ও অর্থপূর্ণ জীবন চান, তা হলে এমন অগ্রাধিকারগুলো নির্ধারণ করুন, যেগুলো বাইবেলে দেওয়া নির্ভরযোগ্য প্রজ্ঞা প্রতিফলিত করে।