সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন | দায়ূদ

“এই যুদ্ধ সদাপ্রভুর”

“এই যুদ্ধ সদাপ্রভুর”

সৈন্যরা যখন দায়ূদের পাশ দিয়ে ছুটে পালাতে থাকে, তখন তিনি কোনোরকমে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর সময় তাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখা যায়। কী কারণে তারা এতটা ভীত হয়ে পড়েছে? বার বার, দায়ূদ নিশ্চয়ই তাদেরকে একটা শব্দই বলতে শুনেছিলেন—একজন ব্যক্তির নাম। আর উপত্যকার ঠিক তলদেশে সেই ব্যক্তি স্বয়ং বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি হয়তো দায়ূদের দেখা সবচেয়ে দীর্ঘকায় ব্যক্তি।

তার নাম হল গলিয়াৎ! তাকে দেখার পর দায়ূদ বুঝতে পারেন, কেন সৈন্যরা এতটা ভীত হয়ে পড়েছে। কারণ তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক বড়ো এবং বিশাল আকৃতির এক মানুষ। এমনকী ভারী যুদ্ধসজ্জা ছাড়াই তার ওজন হয়তো বড়োসড়ো দু-জন পুরুষের চেয়েও বেশি। কিন্তু, তার কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল এবং তিনি ছিলেন খুবই শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ এক যোদ্ধা। গলিয়াৎ চিৎকার করে ইস্রায়েলীয়দের এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান জানান। কল্পনা করে দেখুন, তিনি যখন ইস্রায়েলীয় সৈন্য ও তাদের রাজা শৌলকে টিটকারী দিচ্ছিলেন, তখন তার ভারী আওয়াজ পাহাড়ের চারিদিকে কীভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল! তিনি তাদের মধ্যে থেকে একজন ব্যক্তিকে এসে একাই তার সঙ্গে লড়াই করার আহ্বান জানান!—১ শমূয়েল ১৭:৪-১০.

ইস্রায়েলীয়রা ভয়ে এগোতে পারছে না। রাজা শৌল ভয়ে এগোতে পারছেন না। দায়ূদ জানতে পারেন, এই অবস্থা প্রায় এক মাস ধরে চলছে! গলিয়াৎ দিনের পর দিন টিটকারি দিয়েই যাচ্ছেন আর দু-পক্ষের সৈন্যদল অর্থাৎ পলেষ্টীয় ও ইস্রায়েলীয় সৈন্যদল নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতি দেখে দায়ূদ হতাশ হয়ে পড়েন। কত লজ্জাজনক যে, ইস্রায়েলের রাজা ও তার সৈন্যরা—যাদের মধ্যে দায়ূদের তিন দাদাও রয়েছে—ভয়ে সিটিয়ে আছে! দায়ূদের দৃষ্টিতে, সেই প্রতিমাপূজক গলিয়াৎ যে কেবল ইস্রায়েলীয় সৈন্যদের অপমান করছিলেন, তা নয়; তিনি ইস্রায়েলের ঈশ্বর যিহোবাকে টিটকারি দিচ্ছিলেন! কিন্তু, একজন অল্পবয়সি হিসেবে দায়ূদের পক্ষে কি কিছু করা সম্ভব? আর বর্তমানে আমরা দায়ূদের বিশ্বাস থেকে কোন শিক্ষা লাভ করতে পারি?—১ শমূয়েল ১৭:১১-১৪.

“ইহাকে অভিষেক কর, কেননা এ সেই ব্যক্তি”

আসুন আমরা বেশ কয়েক মাস পিছনে ফিরে যাই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। দায়ূদ বৈৎলেহমের কাছাকাছি কোনো পাহাড়ের ধারে তার বাবার মেষদের যত্ন নিচ্ছেন। সম্ভবত সেই সময় তিনি কিশোরবয়সি ছিলেন। তিনি সুদর্শন ও আকর্ষণীয় ছিলেন এবং তার গাল ছিল ঈষৎ লাল ও চোখ খুবই সুন্দর। শান্ত মুহূর্তগুলোতে তিনি বসে বসে বীণা বাজাতেন এবং ঈশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি উপভোগ করতেন। আর বহু সময় ধরে এভাবে চর্চা করার মাধ্যমে সংগীতের বিষয়ে তার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, সবেমাত্র উল্লেখিত সেই সন্ধ্যায় দায়ূদকে ডেকে পাঠানো হয়। তার বাবা এক্ষুণি তার সঙ্গে দেখা করতে চান।—১ শমূয়েল ১৬:১২.

বাড়িতে এসে তিনি দেখতে পান, তার বাবা যিশয় খুবই বৃদ্ধ একজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন। সেই ব্যক্তি হলেন বিশ্বস্ত ভাববাদী শমূয়েল। যিহোবা তাকে যিশয়ের বাড়িতে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি তার এক ছেলেকে ইস্রায়েলের ভাবী রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন! ইতিমধ্যে শমূয়েল দায়ূদের সাত জন দাদাকে দেখেছেন কিন্তু যিহোবা শমূয়েলকে জানান যে, তিনি তাদের কাউকেই মনোনীত করেননি। তবে, যখন দায়ূদ বাড়িতে আসেন, তখন যিহোবা শমূয়েলকে বলেন: “ইহাকে অভিষেক কর, কেননা এ সেই ব্যক্তি।” দায়ূদের দাদাদের সামনে, শমূয়েল দায়ূদের মাথায় তৈলশৃঙ্গ থেকে এক বিশেষ তেল ঢেলে তাকে অভিষিক্ত করেন। সেই অভিষেকের পর থেকে দায়ূদের জীবন পুরোপুরি পালটে যায়। বাইবেল বলে: “সেই দিন হইতে সদাপ্রভুর আত্মা দায়ুদের উপরে আসিলেন।”—১ শমূয়েল ১৬:১, ৫-১১, ১৩.

বন্যপশুদের পরাজয় করার কৃতিত্ব দায়ূদ নম্রভাবে যিহোবাকেই দিয়েছিলেন

এই অভিষেকের কারণে দায়ূদ কি রাজপদ লাভ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন? না। তিনি শান্তভাবে অপেক্ষা করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, যখন সময় আসবে, তখন যিহোবার পবিত্র আত্মা তাকে আরও বড়ো বড়ো দায়িত্ব পালন করার জন্য পরিচালনা দেবে। অপেক্ষা করার এই সময়টাতে তিনি মেষপালকের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন, যা ছিল তুলনামূলকভাবে নীচু কাজ। এই কাজটা তিনি সম্পূর্ণ নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে করে গিয়েছিলেন। তার বাবার মেষপাল দু-বার আক্রমণের মুখে পড়েছিল, একবার এক সিংহের দ্বারা এবং আরেক বার একটা ভল্লুকের দ্বারা। দায়ূদ কেবল নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেই আক্রমণকারীদের তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। বরং, তার বাবার অসহায় মেষদের রক্ষা করার জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ সেই পশুদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। দু-বারই তিনি সেই হিংস্র বন্যপশুদের একাই হত্যা করেছিলেন!—১ শমূয়েল ১৭:৩৪-৩৬; যিশাইয় ৩১:৪.

পরে, দায়ূদকে আরও একবার ডেকে পাঠানো হয়। তার সুনাম রাজা শৌলের কানে পৌঁছায়। সেইসময়, যদিও শৌল একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু ঈশ্বরের নির্দেশনা অমান্য করায় তিনি যিহোবার অনুমোদন হারিয়ে ফেলেছিলেন। যিহোবা শৌলের উপর থেকে পবিত্র আত্মা সরিয়ে নেন আর তাই এক দুষ্ট আত্মা এসে রাজাকে উদ্‌বিগ্ন করত অর্থাৎ তার মধ্যে প্রচণ্ড ক্রোধ, সন্দেহ এবং হিংস্র মনোভাবের মতো নেতিবাচক অনুভূতিগুলো জেগে উঠত। শৌলের মধ্যে যখন এই অনুভূতিগুলো জেগে উঠত, তখন কেবল একটা বিষয়ই তাকে স্বস্তি দিতে পারত আর সেটা হল, সংগীত। শৌলের কিছু লোক জানতে পেরেছিল যে, একজন বাদক ও যোদ্ধা হিসেবে দায়ূদের সুনাম রয়েছে। তাই, দায়ূদকে ডেকে পাঠানো হয় আর শীঘ্র তিনি রাজপ্রাসাদে শৌলের জন্য বাদক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন এবং তার একজন অস্ত্রবাহক হয়ে ওঠেন।—১ শমূয়েল ১৫:২৬-২৯; ১৬:১৪-২৩.

বিশেষভাবে তরুণ-তরুণীরা এই ক্ষেত্রগুলোতে দায়ূদের বিশ্বাস থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। লক্ষ করো, অবসর সময়ে তিনি এমন কাজগুলো করেছিলেন, যেগুলো তাকে যিহোবার আরও নিকটবর্তী করে তুলেছিল। এ ছাড়া, তিনি শান্তভাবে এমন দক্ষতা গড়ে তুলেছিলেন, যেগুলো ব্যাবহারিক এবং সহজেই কাজ পাওয়ার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তিনি যিহোবার পবিত্র আত্মার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। এই বিষয়গুলো থেকে আমরা সকলে কত চমৎকার শিক্ষাই-না লাভ করতে পারি!—উপদেশক ১২:১.

“উহার জন্য কাহারও অন্তঃকরণ হতাশ না হউক”

শৌলের সেবা করার পাশাপাশি, মাঝে মাঝে দায়ূদ বাড়ি ফিরে গিয়ে মেষপালও চরাতেন এবং কখনো কখনো তিনি সেটা দীর্ঘসময়ের জন্য করতেন। এইরকম একটা সময়েই যিশয় দায়ূদকে তার দাদাদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন, যারা শৌলের সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতেন। বাবার কথামতো দায়ূদ তাদের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে এলা তলভূমির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছানোর পর দায়ূদ দু-পক্ষের সৈন্যদলকে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন, যে-বিষয়ে এই প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই বিস্তৃত ও ঢালু উপত্যকার এক দিকে ছিল ইস্রায়েলীয় সৈন্যদল এবং অন্যদিকে পলেষ্টীয় সৈন্যদল।—১ শমূয়েল ১৭:১-৩, ১৫-১৯.

দায়ূদের কাছে এই পরিস্থিতি সহ্য করার মতো নয়। জীবন্ত ঈশ্বর যিহোবার সৈন্যদল হয়ে কীভাবে তারা এই সামান্য এক মানুষের ভয়ে, একজন প্রতিমাপূজকের ভয়ে পালিয়ে যেতে পারে? গলিয়াতের এই টিটকারীকে দায়ূদ সরাসরি যিহোবারই অপমান বলে মনে করেন। তাই, তিনি অত্যন্ত উৎসাহ সহকারে গলিয়াৎকে পরাজিত করার বিষয়ে সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। দায়ূদের দাদা ইলীয়াব তার এই কথা শুনতে পান। তিনি তার ছোটো ভাইয়ের উপর অত্যন্ত রেগে গিয়ে তাকে বকাঝকা করেন ও এই দোষারোপ করেন যে, দায়ূদ নিশ্চয়ই যুদ্ধ দেখার উদ্দেশ্যেই সেখানে এসেছে। কিন্তু, দায়ূদ তাকে বলেন: “আমি কি করিলাম? এ কি বাক্যমাত্র নহে?” এর ঠিক পরেই তিনি অত্যন্ত আস্থা সহকারে গলিয়াৎকে পরাজিত করার কথা বলতে থাকেন আর একসময় তা শৌলের কানে গিয়ে পৌঁছায়। রাজা শৌল দায়ূদকে তার সামনে হাজির করার আদেশ দেন।—১ শমূয়েল ১৭:২৩-৩১.

গলিয়াতের বিষয়ে রাজা শৌলকে দায়ূদ এই উৎসাহজনক কথাগুলো বলেন: “উহার জন্য কাহারও অন্তঃকরণ হতাশ না হউক।” সত্যিই, গলিয়াতের কারণে শৌল এবং তার লোকেরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা যে-ভুলটা করেছিল, সেটা হল নিজেদেরকে সেই বিশাল আকৃতির মানুষের সঙ্গে তুলনা করা, যার সামনে গেলে তাদের উচ্চতা হবে কেবল তার পেটের কিংবা বুকের সমান। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেই দৈত্যাকৃতি ব্যক্তির কাছে তাদের পরাজয় তারা স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছিল। কিন্তু, দায়ূদ তাদের মতো করে চিন্তা করেননি। আমরা লক্ষ করব যে, তিনি সমস্যাটাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তাই, তিনি নিজেই গলিয়াতের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন বলে জানান।—১ শমূয়েল ১৭:৩২.

কিন্তু, শৌল এই বলে আপত্তি জানান: “তুমি ঐ পলেষ্টীয়ের বিরুদ্ধে গিয়া তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে পারিবে না, কেননা তুমি বালক, এবং সে বাল্যকাল অবধি যোদ্ধা।” দায়ূদ কি আসলেই বালক ছিলেন? না, আসলে সৈন্যদলে যোগ দেওয়ার জন্য তার বয়স খুব কম ছিল এবং তাকে দেখেও হয়তো কমবয়সি বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু, ইতিমধ্যেই দায়ূদ একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন আর ততদিনে তার বয়স হয়তো ১৮-১৯ বছর হয়ে গিয়েছিল।—১ শমূয়েল ১৬:১৮; ১৭:৩৩.

একটা সিংহ এবং ভল্লুককে তিনি কীভাবে হত্যা করেছিলেন, সেই ঘটনা বলার মাধ্যমে দায়ূদ শৌলকে আশ্বস্ত করেন। তিনি কি বড়াই করছিলেন? না। দায়ূদ জানতেন, কার সাহায্যে তিনি সেই লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি বলেন: “সদাপ্রভু সিংহের থাবা ও ভল্লুকের থাবা হইতে আমাকে উদ্ধার করিয়াছেন, তিনি এই পলেষ্টীয়ের হস্ত হইতে আমাকে উদ্ধার করিবেন।” অবশেষে শৌল রাজি হয়ে বলেন: “যাও, সদাপ্রভু তোমার সহবর্ত্তী হইবেন।”—১ শমূয়েল ১৭:৩৭.

আপনিও কি দায়ূদের মতো বিশ্বাস দেখাতে চান? যদি চান, তা হলে লক্ষ করুন, দায়ূদের বিশ্বাসের ভিত্তি অবাস্তব ছিল না। বরং, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন। তিনি জানতেন, যিহোবা হলেন একজন প্রেমময় সুরক্ষাকারী ও সেইসঙ্গে তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন। আমরা যদি এই ধরনের বিশ্বাস অর্জন করতে চাই, তা হলে আমাদেরকে বাইবেল থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে জানতে হবে। এরপর, আমরা যা শিখি, সেই অনুযায়ী যদি জীবনযাপন করি, তা হলে আমরা দেখব যে, এর ফলে প্রাপ্ত উত্তম ফল আমাদের বিশ্বাসকেও শক্তিশালী করবে।—ইব্রীয় ১১:১.

“সদাপ্রভু তোমাকে আমার হস্তে সমর্পণ করিবেন”

শৌল প্রথমে দায়ূদকে তার নিজের যুদ্ধসজ্জা পরিয়ে দেন। এই যুদ্ধসজ্জা ছিল পিতলের তৈরি, যা অনেকটা গলিয়াতের যুদ্ধসজ্জার মতো। এর মধ্যে খুব সম্ভবত বিশাল এক বর্মও ছিল, যেটা ছোটো ছোটো ধাতব টুকরো দিয়ে এমনভাবে তৈরি যে, দেখতে কিছুটা মাছের আঁশের মতো। দায়ূদ সেই বিশাল ও ভারী যুদ্ধসজ্জা পরে চলার চেষ্টা করেন কিন্তু বেশি সময় চলতে পারেন না। যেহেতু তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো সৈন্য ছিলেন না, তাই যুদ্ধসজ্জা পরার অভ্যাস তার ছিল না আর বিশেষভাবে শৌলের যুদ্ধসজ্জা পরে চলাফেরা করার তো প্রশ্নই আসে না, কারণ তিনি ছিলেন ইস্রায়েলের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা! (১ শমূয়েল ৯:২) তিনি সেই যুদ্ধসজ্জা খুলে ফেলেন এবং তিনি যেগুলোতে অভ্যস্ত সেগুলোই তুলে নেন—একজন মেষপালক তার পালকে রক্ষা করার জন্য যে-জিনিসগুলো ব্যবহার করেন।—১ শমূয়েল ১৭:৩৮-৪০.

দায়ূদ মেষপালের জন্য ব্যবহৃত তার যষ্টি, কাঁধে একটা ঝোলা এবং ফিঙে বা গুলতি নেন। যদিও গুলতিকে খুব সাধারণ এক অস্ত্র বলে মনে হয় কিন্তু আসলে এটা খুবই কার্যকরী ছিল। চামড়ার তৈরি দুটো লম্বা ফিতের মাথায় ছোট্ট একটা থলে দেওয়া এই গুলতি ছিল একজন মেষপালকের জন্য এক আদর্শ অস্ত্র। তিনি সেই থলের মধ্যে একটা পাথর রেখে, সেটা মাথার উপর দ্রুতগতিতে ঘোরাতেন এবং এরপর একটা ফিতে ছেড়ে দিয়ে ঠিক জায়গামতো পাথরটা ছুড়ে মারতেন। এটা এতটাই কার্যকরী ছিল যে, যুদ্ধের সময় মাঝে মাঝে গুলতি ব্যবহারকারী সৈন্যদেরও কাজে লাগানো হতো।

এভাবে সজ্জিত হয়ে দায়ূদ তার শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার জন্য ছুটে যান। আমরা মনের চোখে কল্পনা করতে পারি, উপত্যকার মধ্যে একটা শুষ্ক নদীপথ থেকে পাঁচটা ছোটো ছোটো মসৃণ পাথর তুলে নেওয়ার সময় দায়ূদ কতটা আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করছেন। এরপর তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যান—হেঁটে হেঁটে নয় বরং দৌড়ে!

গলিয়াৎ যখন তার বিরোধীকে দেখেন, তখন তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়? বাইবেল বলে, গলিয়াৎ “দায়ূদকে দেখিতে পাইয়া তুচ্ছজ্ঞান করিল; কেননা তিনি বালক, ঈষৎ রক্তবর্ণ ও দেখিতে সুন্দর ছিলেন।” গলিয়াৎ গমগমে গলায় বলেন: “আমি কি কুকুর যে, তুই দণ্ড লইয়া আমার কাছে আসিতেছিস্‌?” স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তিনি কেবল দায়ূদের যষ্টিটাই লক্ষ করেছিলেন, গুলতিটা লক্ষ করেননি। তিনি পলেষ্টীয় দেবতাদের নাম নিয়ে দায়ূদকে অভিশাপ দেন এবং তার মৃতদেহ পাখিদের ও বন্যপশুদের খাওয়াবেন বলে দিব্য করেন।—১ শমূয়েল ১৭:৪১-৪৪.

উত্তরে দায়ূদ যা বলেছিলেন, সেটা এখনও বিশ্বাসের এক অসাধারণ অভিব্যক্তি হিসেবে রক্ষিত আছে। কল্পনা করে দেখুন, অল্পবয়সি দায়ূদ গলিয়াতের উদ্দেশে চিৎকার করে বলছেন: “তুমি খড়্‌গ, বড়শা ও শল্য লইয়া আমার কাছে আসিতেছ, কিন্তু আমি বাহিনীগণের সদাপ্রভুর, ইস্রায়েলের সৈন্যগণের ঈশ্বরের নামে, তুমি যাঁহাকে টিট্‌কারি দিয়াছ তাঁহারই নামে, তোমার নিকটে আসিতেছি।” দায়ূদ জানতেন, মানুষের শক্তি ও অস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ নয়। গলিয়াৎ যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি অসম্মান দেখিয়েছিলেন এবং যিহোবাই এর উত্তর দেবেন। দায়ূদ এভাবে বলেন, “এই যুদ্ধ সদাপ্রভুর।”—১ শমূয়েল ১৭:৪৫-৪৭.

দায়ূদ যে গলিয়াতের আকৃতি অথবা অস্ত্রশস্ত্রকে উপেক্ষা করেছিলেন, তা নয়। তবে, এই বিষয়গুলো দেখে তিনি দমে যাননি। শৌল ও তার সৈন্যবাহিনী যে-ভুল করেছিল, তিনি সেই একই ভুল করেননি। তিনি গলিয়াতের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেননি। বরং, তিনি জানতেন, যিহোবার সামনে গলিয়াতের অবস্থান আসলে কী। যেহেতু গলিয়াতের উচ্চতা প্রায় সাড়ে নয় ফুট (২.৯ মিটার) ছিল, তাই অন্যদের সামনে দাঁড়ালে তাকে হয়তো দৈত্য বলে মনে হতো। তবে, নিখিলবিশ্বের সর্বক্ষমতাময় ব্যক্তির সামনে এই আকৃতি কোনো ব্যাপারই ছিল না। কারণ অন্যান্য মানুষের মতো তিনিও যিহোবার কাছে খুবই ক্ষুদ্র এবং নগণ্য ছিলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা হল, শীঘ্রই যিহোবা তাকে বিনষ্ট করতে যাচ্ছেন।

দায়ূদ তার ঝোলা থেকে একটা পাথর বের করতে করতে দৌড়ে তার শত্রুর দিকে এগিয়ে যান। তিনি গুলতির মধ্যে পাথর বসান এবং এরপর সেটা মাথার উপরে ঘোরাতে থাকেন আর একসময় শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যায়। গলিয়াৎ সম্ভবত তার ঢালির পিছনে থেকে দায়ূদের দিকে এগিয়ে আসেন। গলিয়াতের বিশাল উচ্চতাই হয়তো তার জন্য বিপদ ডেকে এনেছিল, কারণ সাধারণ আকৃতির একজন ঢালির পক্ষে কোনোভাবেই সেই দৈত্যাকৃতি ব্যক্তির মাথা পর্যন্ত ঢাল উঁচু করে তার মাথা রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। আর দায়ূদের লক্ষ্য ছিল ঠিক সেটাই।—১ শমূয়েল ১৭:৪১.

দায়ূদ জানতেন, যিহোবা ঈশ্বরের সামনে এমনকী একজন দৈত্যাকৃতি ব্যক্তিও একেবারেই নগণ্য

দায়ূদ পাথর ছুড়ে মারেন। কল্পনা করুন, পাথরটা নিঃশব্দে নিশানা বরাবর ছুটে যাচ্ছে। যিহোবা তার সঙ্গে ছিলেন বলে দায়ূদকে দ্বিতীয় বার আর পাথর ছুড়তে হয় না। পাথরটা লক্ষ্যভেদ করে ঠিক গলিয়াতের কপালে বসে যায়। আর মহাশক্তিধর এই ব্যক্তি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যান! তার ঢালি সম্ভবত ভয়ে পালিয়ে যান। দায়ূদ দৌড়ে যান, গলিয়াতের খড়্গ নেন এবং সেটা দিয়েই সেই দৈত্যাকৃতি ব্যক্তির মাথা কেটে ফেলেন।—১ শমূয়েল ১৭:৪৮-৫১.

অবশেষে, শৌল ও তার সৈন্যরা সাহস ফিরে পান। জয়ধ্বনি সহকারে তারা পলেষ্টীয়দের ধাওয়া করেন। দায়ূদ গলিয়াৎকে যা বলেছিলেন, যুদ্ধে ঠিক সেটাই ঘটেছিল: “সদাপ্রভু . . . তোমাদিগকে আমাদের হস্তে সমর্পণ করিবেন।”—১ শমূয়েল ১৭:৪৭, ৫২, ৫৩.

আজকে, ঈশ্বরের দাসেরা আক্ষরিক যুদ্ধে অংশ নেয় না। সেই সময় অতীত হয়ে গিয়েছে। (মথি ২৬:৫২) তবুও, আমাদেরকে দায়ূদের বিশ্বাস অনুকরণ করতে হবে। তার মতো আমাদেরও যিহোবাকে একজন বাস্তব ব্যক্তি হিসেবে দেখতে হবে—একমাত্র তাঁকেই ঈশ্বর হিসেবে সেবা করতে হবে এবং শ্রদ্ধা করতে হবে। কখনো কখনো, আমরা হয়তো আমাদের সমস্যার সঙ্গে তুলনা করে নিজেদেরকে ছোটো বলে মনে করতে পারি, কিন্তু যিহোবার অসীম শক্তির তুলনায় আমাদের সমস্যাগুলো একেবারেই ক্ষুদ্র। আমরা যদি যিহোবাকে আমাদের ঈশ্বর হিসেবে বেছে নিই এবং দায়ূদের মতো তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখি, তা হলে কোনো বাধা বা সমস্যাই আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। কারণ এমন কোনো বাধা নেই, যা যিহোবার পক্ষে জয় করা অসম্ভব! ▪ (wp16-E No. 5)